জাতিসংঘ: শান্তি ও সহযোগিতার সূচনা
বিশ্বযুদ্ধ ও ধ্বংসের পটভূমিতে মানবজাতি যখন শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য এক বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মের প্রয়োজন অনুভব করেছিল, তখনই জাতিসংঘের জন্ম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা, কোটি কোটি প্রাণহানি, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং অর্থনৈতিক ধ্বংসযজ্ঞ সারা বিশ্বকে চেতনায় নাড়া দেয়।
সেই অভিজ্ঞতা থেকেই গড়ে ওঠে একটি নতুন আন্তর্জাতিক সংগঠন – জাতিসংঘ (United Nations) – যার মূল লক্ষ্য ছিল আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি সাধন।
জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পটভূমি
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল “লীগ অব নেশনস” (League of Nations), তবে এটি শান্তি রক্ষায় কার্যকর হতে পারেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫) আবারও প্রমাণ করে দেয় যে একটি শক্তিশালী, কার্যকর ও সার্বজনীন সংগঠনের প্রয়োজন রয়েছে, যেটি যুদ্ধ প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবে।
১৯৪১ সালের আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল “আটলান্টিক চার্টার” (Atlantic Charter) স্বাক্ষর করেন, যেখানে ভবিষ্যৎ শান্তিপূর্ণ বিশ্বের জন্য একটি আন্তর্জাতিক কাঠামোর কথা বলা হয়। এই ঘোষণার ভিত্তিতে ১৯৪২ সালে ২৬টি দেশ “United Nations Declaration”-এ স্বাক্ষর করে, যা ছিল একটি সাময়িক যুদ্ধকালীন মৈত্রী চুক্তি। কিন্তু এখান থেকেই “United Nations” শব্দটির আনুষ্ঠানিক ব্যবহার শুরু হয়।
সদর দপ্তর
জাতিসংঘের সদর দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে অবস্থিত। এটি ১৬ একর জমিতে ১৯৪৯হতে ১৯৫০ সালের মধ্যে নির্মাণ করা হয়। ভবনটি ইস্ট নদীর তীরে অবস্থিত। সদর দপ্তর স্থাপনের জমি কেনার জন্য জন ডি রকফেলার জুনিয়র ৮.৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেন। তিনি জাতিসংঘকে এই জমি দান করেন।
সদর দপ্তরের মূল ভবনটির নকশা প্রণয়ন করেন – লে করবুসিয়ে, অস্কার নিয়েমেয়ারসহ আরো অনেক খ্যাতনামা স্থপতি। নেলসন রকফেলারের উপদেষ্টা ওয়ালেস কে হ্যারিসন এই স্থপতি দলের নেতৃত্ব দেন। আনুষ্ঠানিকভাবে সদর দপ্তরের উদ্বোধন হয় ১৯৫১ সালের ৯ই জানুয়ারি তারিখে।
সদর দপ্তর নিউইয়র্কে হলেও জাতিসংঘের বেশ কিছু অঙ্গ সংগঠনের প্রধান কার্যালয় সুইজারল্যান্ডের জেনেভা, নেদারল্যান্ডসের হেগ, অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা, কানাডার মন্ট্রিয়ল, ডেনমার্কের কোপেনহেগেন, জার্মানীর বন ও অন্যত্র অবস্থিত।
জাতিসংঘের সদর দপ্তরের ঠিকানা হল –
760 United Nations Plaza,
New York City, NY 10017,
USA
নিরাপত্তার খাতিরে এই ঠিকানায় প্রেরিত সকল ধরনের চিঠিপত্র পরীক্ষণ-নিরীক্ষণসহ জীবাণুমুক্ত করা হয়।
জাতিসংঘের সদর দপ্তরের পুরানো ভবনের সংস্কার কার্য উপলক্ষে ম্যানহাটানের ফার্স্ট অ্যাভিনিউতে ফুমিহিকো মাকির নকশায় অস্থায়ী দপ্তর নির্মাণ করা হচ্ছে।
১৯৪৯ সালের আগে পর্যন্ত লন্ডন ও নিউইয়র্কের বিভিন্ন স্থানে জাতিসংঘের কার্যালয়ের অবস্থান ছিল।
ভাষা
জাতিসংঘের ছয়টি দাপ্তরিক ভাষা হলো আরবি, চীনা, ইংরেজি, ফরাসি, রুশ, এবং স্পেনীয় ভাষা। জাতিসংঘের সচিবালয়ে যে দুটি ভাষা ব্যবহৃত হয় তা হলো ইংরেজি ও ফরাসি।
জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষাগুলোর মধ্যে ইংরেজি ৫৪টি সদস্য দেশের সরকারি ভাষা। ফরাসি হলো ২৯টি দেশের, আরবি ২৪টি দেশের, স্পেনীয় ২১টি দেশের, রুশ ১০টি দেশের, এবং চীনা ভাষা ৪টি দেশের সরকারি ভাষা।
এছাড়াও জাতিসংঘে কিছু প্রস্তাবিত দাপ্তরিক ভাষা হলো বাংলা, হিন্দি, জার্মান, পর্তুগিজ, মালয়, তুর্কি, জাপানি, সোয়াহিলি ইত্যাদি ।
সান ফ্রান্সিসকো সম্মেলন ও জাতিসংঘ সনদ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে, ১৯৪৫ সালের ২৫ এপ্রিল থেকে ২৬ জুন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকো শহরে একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় – যা পরিচিত “সান ফ্রান্সিসকো কনফারেন্স” নামে। সম্মেলনে ৫০টি দেশের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন, এবং তারা সম্মিলিতভাবে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। সম্মেলনের শেষ দিনে – ২৬ জুন ১৯৪৫ – “United Nations Charter” বা জাতিসংঘ সনদ গৃহীত হয়।
এই সনদের মাধ্যমে জাতিসংঘের কাঠামো, উদ্দেশ্য, সদস্যপদ, কার্যপ্রণালী এবং অধিকার নির্ধারণ করা হয়। সনদটি আনুষ্ঠানিকভাবে ২৪ অক্টোবর ১৯৪৫ থেকে কার্যকর হয়, এবং সেই দিনটিকে এখন “জাতিসংঘ দিবস” হিসেবে পালন করা হয়।
জাতিসংঘের প্রধান উদ্দেশ্যসমূহ
জাতিসংঘ একটি আন্তর্জাতিক তথা বিশ্ব প্রতিষ্ঠান। বিশ্বের যে কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র জাতিসংঘের সদস্য হতে পারে।জাতিসংঘ কিছু মহৎ উদ্দেশ্য অর্জনের লক্ষ্যে গঠিত হয়েছে।জাতিসংঘ গঠনের সাতটি লক্ষ ও উদ্দেশ্য হচ্ছে-
১. বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা।
২. বিভিন্ন জাতি তথা দেশের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপন করা।
৩. অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের মধ্যে সহযোগিতা গড়ে তোলা।
৪. জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকারের প্রতি সম্মান গড়ে তোলা।
৫. বিভিন্ন দেশের মধ্যে বিদ্যমান বিবাদ মীমাংসা করা।
৬. প্রত্যেক জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের স্বীকৃতি ও তার সমুন্নত রাখা, এবং
৭.উদ্দেশ্যসমূহ বাস্তবায়নের জন্য জাতিসংঘের কার্যধারা অনুসরণ করা ৷
একটি কার্যকর কেন্দ্র হিসাবে কাজ করা, যেখান থেকে দেশসমূহ তাদের অভিন্ন সমস্যা সমাধানে একত্রিত হতে পারে।
উদ্দেশ্যগুলো বাস্তবায়নের জন্য জাতিসংঘ তার ছয়টি শাখার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের কাজ করে থাকে।
প্রধান অঙ্গসংগঠন
জাতিসংঘের গঠন অত্যন্ত বিস্তৃত ও কার্যকর। এর ছয়টি প্রধান অঙ্গসংগঠন রয়েছে:
জেনারেল অ্যাসেম্বলি (General Assembly) – সমস্ত সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা এখানে অংশ নেন।
সিকিউরিটি কাউন্সিল (Security Council) – আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়; ৫টি স্থায়ী সদস্য ও ১০টি অস্থায়ী সদস্য রয়েছে।
ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কাউন্সিল (ECOSOC) – অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সহযোগিতা নিয়ে কাজ করে।
ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (ICJ) – নেদারল্যান্ডসের হেগ-এ অবস্থিত আন্তর্জাতিক বিচারালয়।
সেক্রেটারিয়েট (Secretariat) – জাতিসংঘের প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা করে, যার নেতৃত্বে আছেন মহাসচিব।
ট্রাস্টশিপ কাউন্সিল – অধীনস্থ অঞ্চলগুলোর তত্ত্বাবধানের জন্য গঠিত, যদিও বর্তমানে এটি কার্যত অকার্যকর।
জাতিসংঘের বর্তমান প্রভাব ও ভূমিকা
জাতিসংঘ এখন প্রায় ১৯৩টি দেশের একটি বৃহৎ পরিবার। এটি বিশ্বে শান্তি রক্ষায়, যুদ্ধবিরতি তদারকিতে, মানবাধিকার প্রচারে, শরণার্থীদের সহায়তায়, দারিদ্র্য বিমোচনে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs) অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে।
বিশ্বজুড়ে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, যেমন – UNESCO, UNICEF, WHO, UNDP, FAO – মানবকল্যাণে বিভিন্ন প্রকল্প পরিচালনা করে। শান্তিরক্ষা মিশনের অংশ হিসেবে জাতিসংঘের নীল হেলমেটধারী শান্তিরক্ষীরা বিশ্বজুড়ে সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে দায়িত্ব পালন করেন।
সমালোচনা ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ
যদিও জাতিসংঘ একটি আদর্শভিত্তিক সংস্থা, তবুও সময় সময় এর কার্যকারিতা নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। সিকিউরিটি কাউন্সিলে ভেটো ক্ষমতা (বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ও ফ্রান্স-এর ক্ষেত্রে) অনেক সময় ন্যায়বিচারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
এছাড়া, কিছু উন্নয়নশীল দেশ জাতিসংঘের ক্ষমতার ভারসাম্য, অর্থায়ন কাঠামো এবং প্রতিনিধিত্ব নিয়েও প্রশ্ন তোলে। জলবায়ু পরিবর্তন, সাইবার নিরাপত্তা, মহামারির মতো বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় জাতিসংঘের আরও সংস্কার প্রয়োজন বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মত দেন।
জাতিসংঘ একটি ভবিষ্যৎমুখী স্বপ্নের প্রতীক, যেখানে প্রতিটি দেশ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের লক্ষ্য নিয়ে এক ছাতার নিচে আসতে পারে। যদিও এটি একটি পরিপূর্ণ ও নির্ভুল সংস্থা নয়, তবুও বিশ্বে সংঘাত নিরসন, দারিদ্র্য হ্রাস এবং মানবাধিকারের প্রসারে এর ভূমিকাকে অস্বীকার করার উপায় নেই।
জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা ছিল এক ঐতিহাসিক অধ্যায়, যা এখনো বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষের শান্তি, নিরাপত্তা এবং উন্নয়নের আশা জাগিয়ে তোলে। ভবিষ্যতে এ সংস্থার উন্নয়ন ও সংস্কার আরও কার্যকরভাবে একটি ন্যায়ভিত্তিক বিশ্ব গঠনে অবদান রাখতে পারে।
তথ্যসূত্র
United Nations Official Website
UN Charter (1945)
Encyclopedia Britannica – United Nations
History.com – United Nations is Formed
UN Peacekeeping Information